কুড়ি শতকের শেষের দিকের অসমিয়া সাহিত্য-জগতের এক উল্লেখযোগ্য ও মানবহিতৈষী কবি হচ্ছেন অবনী চক্রবর্তী।যদিও বিশিষ্ট কবি হিসেবে পরিচিত তবুও তিনি একাধারে ছিলেন নভেলেট লিখিয়ে,অনুবাদক ও সংকলক। তৃতীয় বিশ্বের কবিতাকে অসমিয়ায় রূপান্তর করেছিলেন তিনি।
অবনী জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ৩ জানুয়ারি, তৎকালীন অসমের অবিভক্ত কামরূপ জেলার নলবারি সাবডিভিশানে(বর্তমানে নলবারি জেলা), এক অসমিয়া ব্রাহ্মণ পরিবারে। ১৯৬০ সাল থেকে তাঁর সাহিত্য-অবদানের যাত্রা শুরু হয় এবং চলতে থাকে পূর্ণ-উদ্যমে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ওই সময়টায় তিনি ছিলেন অসমিয়া কবিতা ও সাহিত্য জগতের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেদিন ছিল ১৯৯৪ সালের ১২ ডিসেম্বর, শনিবারের শীতের সন্ধ্যা, গুয়াহাটির খারগুলির বাড়িতে পরিবারের সবাই অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসেছিলেন তিনি কখন সান্ধ্য ভ্ৰমণ থেকে বাড়ি ফিরবেন?কিন্তু আর ফেরেননি।এবং আজো তিনি নিরুদ্দেশ।
কবি অবনীর জীবন-জীবিকার ঠেক ছিল ভারতীয় জীবনবিমা নিগম।পাশাপাশি একটা ছোটোখাটো ছাপাখানাও খুলেছিলেন,সস্তায় অসমিয়া বই-পত্র প্রকাশের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু বেশিদিন চালাতে পারেননি, বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তাঁর স্থাপন করে যাওয়া ‘কবিতা প্রকাশন’-এর কর্মরাজি এখনো অটুট আছে তাঁর পরিবারের সার্বিক সমাদর,অকুণ্ঠ দায়িত্ববোধ আর শ্রদ্ধার সাবলীল ছোঁয়া পেয়ে।
বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল অবনী চক্রবর্তীর। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গোটা কয়েক কবিতা-সংকলন,অনুবাদ-গ্রন্থ ও দু’টি নভেলেট । তৎকালীন বেশিরভা
[‘,গ অসমিয়া প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকাতেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। অসমের বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থা ছাড়াও তাঁর নিজস্ব প্রকাশন-সংস্থা ‘কবিতা প্রকাশন’ থেকেও তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
কবি অবনী দু’টি সাময়িক-পত্রের সংযুক্ত-সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন।যেমন :ষাণ্মাসিক পত্রিকা ‘অন্তরঙ্গ’(১৯৬৯), মাসিক পত্রিকা ‘অসমিয়া কবিতা’(১৯৭০)।১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘চিরন্তন’ শীর্ষক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদকও ছিলেন তিনি।‘প্রতিবাদর কণ্ঠ’ শীর্ষক তাঁর নিজের লেখা মৌলিক কবিতা-আবৃত্তির বাণীবদ্ধ রূপ (ক্যাসেট) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে।এটিই অসমিয়া কাব্যের ইতিহাসে প্রথম কবিতার ক্যাসেট হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, অবনীর মৌলিক কবিতা নিঃসন্দেহে তৎকালীন পাঠক সমাজে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল! তাঁর সেইসব মৌলিক কবিতায় সমৃদ্ধ হয়ে যে-তিনটি অনবদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে : ১) ‘দেহা রমেরমাই মোর’(১৯৭০) ২) ‘শ্লোগান’(১৯৮০) ৩)‘কবিকণ্ঠ’(১৯৮৭)।গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল একটি আত্মজীবনীমূলক নভেলেট ‘শঙ্করদেব উদ্যান,সি আরু অপূর্ব’(১৯৯০)।লিখেছিলেন ‘মর্নিং ওয়াকত চেনেহি বেগম’ শীর্ষক আরেকটি নভেলেট।কিন্তু সেটি বইয়ের মুখ দেখেনি আজো।ছাপা হয়েছিল ‘শ্রীময়ী’ শীর্ষক একটি সাময়িক-পত্রে।
সম্পাদনা করেছিলেন চারখানার মতো কাব্য-সংকলন। সেগুলো হচ্ছে : ১) ‘বৃত্ত ভঙার সময়’ (১৯৭২), ২) ‘এই সময়’ (১৯৭২), ৩) ‘পরশু গোস্বামীর কবিতা’(১৯৮৯), ৪) ‘অমুল্য বরুয়ার জীবন আরু কবিতা’(১৯৯০)।
বেশ কিছু অনূদিত কাব্য-সংকলনের যৌথ সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন অবনী। গ্রন্থগুলো যথাক্রমে : ‘মাও-চে-টুঙর কবিতা’(১৯৭৯), ‘হো চি মিনর কবিতা’( ১৯৭৯), ‘টুং পি ঊর কবিতা’ (১৯৭৯),‘কৃষ্ণাঙ্গ কবির কবিতা’(১৯৮২), ‘ফয়জ আহমদ ফয়জর কবিতা’(১৯৮৫) এবং ‘ মুছা জালিলর কবিতা’(১৯৮৭)।
অবনী চক্রবর্তী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার,পর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের ১২ নভেম্বরের পর তাঁর কবিতাবলি ও জীবনী নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : ‘অবনী চক্রবর্তীর নির্বাচিত কবিতা’ ( প্রকাশক : পুথিনিকেতন, ১৯৯৬), ‘অবনী চক্রবর্তীর স্ব- নির্বাচিত কবিতা সংকলন’(প্রকাশক : ফ্রেন্ডস পাব্লিকেশান, ২০০৪), ‘অবনী চক্রবর্তী : স্মৃতি আরু স্মৃতি’(প্রকাশক : কবিতা প্রকাশন, ২০০৯), ‘স্বপ্নো কে সাথ এক দিন ঠিঠোলি’( দিনকর কুমার কর্তৃক অবনী-কবিতার হিন্দি অনুবাদ।প্রকাশক : কবিতা প্রকাশন,২০১০) এবং ‘খন্থাইগিরনি গারাং’( বিরূপাক্ষ বসুমতারি কর্তৃক অবনী-কবিতার বোড়ো অনুবাদ। প্রকাশক : কবিতা প্রকাশন, ২০১০ ) । এছাড়া, হিন্দি সাময়িক-পত্র ‘উলুপি’র একটি ‘কবি অবনী চক্রবর্তী সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪-এ।
কিছু কিছু অসমিয়া পত্র-পত্রিকায় কবি অবনী চক্রবর্তীর সৃষ্টিরাজি নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। তবে অসমিয়া সাহিত্য-পাঠকের স্বার্থেই এই কবির সৃষ্টিরাজি নিয়ে সামগ্রিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে ভাবছেন অনেকেই। উদগ্রীব পাঠকবর্গ সেটারই অপেক্ষায়।